বিসমিল্লাহ এর ফজিলত আমালিয়াত ১ম খন্ড, ১ম অধ্যায়, ৩য় পর্ব থেকে নেয়া। বিভিন্ন কিতাব থেকে নেয়া বাছাইকৃত এই বিসমিল্লাহ এর ফজিলত সকলের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: হযরত মাওলানা ক্বারী মো: নজরুল ইসলাম সাহেব, ভাদেশ্বরী। (এমএম, এমএ)
আরো কিছু বিসমিল্লাহ এর ফজিলত ও উপকারীতা
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এর অসংখ্য উপকারীতা রয়েছে। তাফসীরে কাবীর ও তাফসীরে আযীযী থেকে এখানে কতিপয় উপকারীতার বর্ণনা করছি-
১. যে ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীর পাশে যাওয়ার সময় অর্থাৎ সহবাসের পূর্বে ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পড়বে তাতে শয়তান শরীক হবে না। এবং সেই সঙ্গমে যদি মায়ের গর্ভে সন্তান ধারণ নিশ্চিত হয়ে যায় তাহলে জরায়ুতে সেই ধারণকৃত বাচ্চার জীবনে যে পরিমাণ শ্বাস নিবে সেই পরিমাণ সওয়াব ও কল্যান তার পিতার আমল নামায় লিপিবদ্ধ হবে।
জ্ঞানী মনীষীদের বাছাইকৃত উক্তিসমূহ পড়তে ভিজিট করুন
২. যে ব্যক্তি কোনো প্রাণীর উপর আরোহণ করার সময় বিসমিল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পড়ে নিবে তাহলে সেই প্রাণীর প্রতিটি কদমের জন্য সেই আরোহীর অনুকূলে একটি সওয়াব বা কল্যান লিপিবদ্ধ হতে থাকবে।
৩. যে ব্যক্তি কোনো নৌ-যানে আরোহণ করার সময় বিসমিল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পড়ে নিবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে সেই আরোহণে বর্তমান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য পূণ্য ও কল্যান লিপিবদ্ধ হবে।
৪. যে রোগী ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পড়ে ঔষধ সেবন করবে ইনশা আল্লাহ তার উপকার হবে।
একটি হেকায়েত
একবার হযরত মূসা (আ) এর পেটে খুব ব্যথা হল। মহান আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন, হে আল্লাহ! আমার ব্যথা কমিয়ে দিন। এরশাদ হল, অরণ্যের অমুক দানা খাও। সুতরাং তিনি সেই দানা খেলেন এবং সাথে সাথে রোগ আরোগ্য হয়ে গেল। কিছুদিন পরে তিনি সেই রোগে আবার আক্রান্ত হলেন। মুসা (আ) তখন পূর্বের ঔষধ সেবন করলেন। কিন্তু ব্যথা তো কমলো না বরং আরো বেড়ে গেল। মহান আল্লাহর দরবারে মুসা (আ) আরজ করলেন- হে আল্লাহ! এ কি রহস্য! ঔষধ এক কিন্তু প্রভাব দু’ধরণের । প্রথমবার এই ঔষধ আরোগ্য দান করল কিন্তু দ্বিতীয় বার রোগ বাড়িয়ে দিল। আল্লাহ বললেন, হে মুসা! সেই বার তুমি আমার পক্ষ থেকে দানার কাছে গিয়েছিলে। আর এবার তুমি তোমার পক্ষ থেকে সেবন করেছ। হে মুসা! শিফা বা আরোগ্য তো আমারই নামের বরকতের মধ্যে নিহিত। আমার নামের বরকত ব্যতীত পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসই ধংসকারী বিষতুল্য। আর আল্লাহর নাম হল প্রতিষেধক।
আমিল হওয়ার জন্য করণীয়
আমিল হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন কিতাবে যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে সহজ ভাষায় এ কথাই বলা যায় যে, কমপক্ষ ৩ চিল্লা অর্থাৎ ১২০ দিন ‘খালওয়াত’ করতে হবে। অর্থাৎ নির্জনতা অবলম্ভন করতে হবে। ‘খালওয়াত’ কিভাবে করবেন তার নিয়ম একটু পরে আলোচিত হবে। ধরুন, আপনি اللٰه يا ইসিমটির আমিল হওয়ার ইরাদা করলেন। তাহলে কিতাবের ভাষ্যমতে اللٰه শব্দে মোট ৪ টি হরফ আছে। এখন প্রশ্ন হল যে, কতবার এই ইসিমটি জপ করলে আমিল হওয়ার শর্ত পূর্ণ হবে। আল্লামা কাশিফ বর্ণী (রঃ) তাঁর লিখিত ‘আমিলে কামিল’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, ১ লক্ষ ২৫ হাজার বার ঐ ইসিম মোবারকটি জপ করলে আমিল হওয়ার শর্ত পূর্ণ হয়ে যাবে। এই হিসেবে প্রতিদিন ৩১২৫ বার করে জপ করলে ৪০ দিনে এক চিল্লা হবে। এভাবে তিন চিল্লা করতে হবে। কিন্তু এই ইসিমের যাকাত আদায় করার আরেকটি হিসেব আছে। যেটা অত্যন্ত কার্যকরী ও ফলপ্রসূ। আর তাহলো যেহেতু اللٰه ইসিমের মাঝে হরফ ৪টি। তাই ৪ সংখ্যাকে ৪ দিয়ে গুণ করে যে ফল বের হবে তাকে আবার ৪ দিয়ে গুণ করবে এভাবে ৭ গুণ করলে যে সংখ্যা বের হবে, সেটাই হবে আমিল হওয়ার জন্য পূর্ণ শর্ত বা তার পূর্ণাঙ্গ যাকাত। এটাকে ‘যাকাতে কুবরা’ বলা হয়। আমি বিষয়টিকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ধরুণ اللٰه শব্দে রয়েছে ৪টি অক্ষর। তাহলে ৪*৪=১৬, ১৬*৪=৬৪, ৬৪*৪=২৫৬, ২৫৬*৪=১০২৪, ১০২৪*৪=৪০৯৬, ৪০৯৬*৪=১৬৩৮৪, ১৬৩৮৪*৪=৬৫৫৩৬, ৬৫৫৩৬*৪=২৬২১৪৪ বার।
অতএব اللٰه ইসিমটির ‘যাকাতে কুবরা’ হল ২৬২১৪৪। কাজেই ‘আল্লাহ’ শব্দটিকে ২৬২১৪৪ বার জপ করলে আমিল হওয়ার শর্ত পূর্ণ হবে। আর ৪০ দিনের ভিতরে ২৬২১৪৪ বার জপ করা শর্ত। ইতেক্বাফ করার সময় ২৬২১৪৪ সংখ্যাটিকে ৪০ দিয়ে ভাগ করে আদায় করতে হবে। এভাবে তিন চিল্লা করতে হবে। (اللٰه اعلم)
খালওয়াত করার নিয়ম
কোনো নির্জন স্থানে বা কোনো নির্জন জঙ্গলে, ময়দানে, পাহাড়ে, প্রয়োজনে নিজ গৃহে বসে আমল শুরু করবেন এবং গৃহটি পবিত্র, কোলাহলমুক্ত, স্ত্রীসহবাসমুক্ত হতে হবে। প্রতিদিন রোজা রাখবেন এবং “তরকে হায়ওয়ানাত” (জালালী ও জামালী) করবেন। অর্থাৎ এই দিনগুলোতে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, মাখন, পনির, মধু এবং কোনো ধরণের প্রাণী ভক্ষণ করা যাবে না। এছাড়া শরীরে কামের উদ্রেগ সৃষ্টি করে এমন কোনো আহার গ্রহন করা যাবে না। নিশা জাতীয় দ্রব্য যেমন-মদ, গাজা, তামাক, জর্দা সেবন করা চলবে না। চিল্লা চলাকালে শরীয়তের পরিপন্থি কোনো না জায়েদ কাজ করা যাবে না। হালাল খাদ্য গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা বর্জন, সব রকম গোনাহের কাজ হতে বিরত থাকাসহ শরীয়তের ফরজ, ওয়াজিব ও রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে চলতে হবে। সারাক্ষণ অযুর সাথে থাকতে হবে। এ সময়ে উচ্চ স্বরে কথা বলা বন্ধ রাখতে হবে এবং বেশি বেশি করে আল্লাহ তা’য়ালার জিকির করবেন এবং আল্লাহর গযবের ভয়ে অধিক পরিমাণ কান্নাকাটি করবেন এবং হাঁসির পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। আমলের শুরুতে ১০০ বার আসতাগফিরুল্লাহ, ১০০ বার দুরূদ শরীফ ও আমল শেষে ১০০ বার দুরূদ শরীফ অজিফা আকারে পাঠ করতে হবে। চিল্লা আরম্ভ করার পূর্বে যাবতীয় গোনাহের উপর খাছ মনে তওবা করা আবশ্যক। অন্যথায় আমল ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। লাগাতার ১২০ দিন আমল করার পর আমলকারী ব্যক্তি এই বিষয়ের আমিল হয়ে যাবেন। আমলের তাছির হর-হামেশা বলবৎ রাখতে চাইলে প্রতিদিন ১১১ বার করে يا اللٰه ইসিমটি জপ করতে হবে। তা না করলে আমলের তাছির বা শক্তি আস্তে আস্তে কমে যাবে। পরিশেষে অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমল করার পূর্বে একজন কামিল ব্যক্তির ইজাজত নিয়ে তবেই আমল শুরু করবেন। তাহলে আর ফলাফল ব্যর্থ হওয়ার আশংকা থাকবে না এবং আমিল ব্যক্তির প্রাণ নাশেরও ভয় থাকবে না। (اعلم اللٰه)
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এর আমিল হওয়ার আমল
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” আয়াতের বদৌলতে আল্লাহ তা’য়ালার কামিল বান্দাগণ হাজার রকমের ফায়দা হাসিল করতে পারবেন। কিন্তু কামিল বান্দা ছাড়া অন্য কেউ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর গায়েবী সাহায্য হাসিল করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই বিসমিল্লাহ এর সাধনা করার মধ্যদিয়ে এর পূর্ণ শক্তি অর্জন করা আবশ্যক। আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) তাঁর লিখিত বেহেস্তি জেওর নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, আমিল হওয়ার চেয়ে কামিল হওয়াই উত্তম। কেননা আমিল ব্যক্তিকে জ্বীন, পরী এবং অশুভ আত্মাসমূহ হাজারো ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে। এমনকি আমিল ব্যক্তির পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিদের উপর আরোপিত হয়ে থাকে নানাবিধ বিপদ-আপদ। সে জন্য আমিল ব্যক্তিকে সর্বদাই থাকতে হয় সর্তক ও সচেতন । কিন্তু কামিল ব্যক্তির জন্য এ ধরনের বিপদের কোনো আশংকা থাকে না। কারণ, তাঁদের উপর থাকে আল্লাহপাকের খাস মেহেরবানী। যাই হোক, যদি কোনো ব্যক্তি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এর আমিল হতে চায়, তাহলে কমপক্ষে ৪০ দিনের চিল্লা প্রয়োজন। চন্দ্রমাসের প্রথম বৃহস্পতিবার অথবা সোমবার আমল শুরু করবেন। প্রতিদিন রোজা রাখবেন। নির্জন কোন স্থানে বা জঙ্গলে বা ময়দানে বা দরিয়ার কিনারে, প্রয়োজনে নিজ গৃহে বসে আমল করবেন। আমল চলাকালীন সময়ে হালাল খাদ্য গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা বর্জন, সব রকম গোনাহের কাজ হতে বিরত থাকাসহ শরীয়তের ফরজ, ওয়াজিব ও মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাতসমূহ পুরোপুরিভাবে পালন করে চলবেন। মাছ, গোস্ত, ঘি, মাখন, দুধ, দধি, লবন ইত্যাদি খাবেন না। শুধু শাক-সবজি (নেমক ছাড়া) অথবা যবের বা আটার রুটি খাবেন। প্রতিদিন একই সময়ে আমল করবেন। যে কামরায় আলম করবেন তাতে সুগদ্ধি ব্যবহার করবেন এবং লোবান ও চন্দন কাঠ জ্বালিয়ে ধুনি দিবেন। আমল শুরু করার পূর্বে ১০০ বার আসতাগফিরুল্লাহ, ১০০ বার দুরূদ শরীফ এবং ৩১২৫ বার নিচের নিয়মে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” তিলাওয়াত করবেন।
اجب يا جبرائيل بحق بسم اللٰه الرحمٰن الرحيم٠
এবং আমল শেষে ১০০ বার আসতাগফিরুল্লাহ, ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে সমস্ত ছোয়াব মহানবী (সাঃ) এর খেদমতে রেছানী করবেন। তারপর হাত তুলে প্রাণ খুঁলে দোয়া করবেন যে, হে আল্লাহ! “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এর মধ্যে যা কিছু নিয়ামত ও বরকত বিদ্যমান আছে, আমাকে দান করে আমার মনোবাসনা পুরা করে দাও! আরো নিজের মনের একান্ত কিছু থাকলে তাও প্রার্থনা করবেন। এভাবে ৪০ দিন আমল করার পর উক্ত ব্যক্তি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এর আমিল হয়ে যাবে। আমল চলাকালীন সময়ে অন্তত ১৯ বার উক্ত আয়াতে কারীমাটি লিখবেন। এতে আরো তাছির পয়দা হবে। চিল্লা যেদিন শেষ হবে সেদিন কিছু দান-খয়রাত করবেন। সম্ভব হলে ফকির-মিছকীনকে খাওয়াবেন। আমলের তাছির সর্বদা জারী রাখতে হলে প্রতিদিন ৭৮৬ বার করে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করতে হবে। (নকসে সুলাইমানী)
বিসমিল্লাহ এর ফজিলত ও উপকারীতা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
(১ম অধ্যায়, ৩য় পর্ব সমাপ্ত)
২য় অধ্যায়, ১ম পর্ব পড়তে ভিজিট করুন
যোগাযোগ: ০১৭১৬-৩৮৬৯৫৮, nazruld@yahoo.com