মসজিদে জামাতে তারাবিহ নামাজ পড়ার নিয়ম আমরা অনেকেই জানি। এই আর্টিকেলে বর্ণিত হয়েছে ঘরে বসে তারাবিহ নামাজ পড়ার নিয়ম। আশা করি পোষ্টটি সকলের উপকারে আসবে।
তারাবিহ নামাজ পড়ার নিয়ম
মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহা অনুগ্রহ, রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস হল রামাদ্বান। এ মাসের মর্যাদা অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো ক্বিয়ামুর রামাদ্বান তথা তারাবিহ নামাজ। আরবিতে তারাবিহ (تَرَاوِيْح) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশ্রাম করা’। লম্বা ক্বিরাতে প্রতি ৪ রাকাআত নামাজ পড়ার পর পর একটু বিশ্রাম গ্রহণ করার মাধ্যমে রাত জেগে যে নামাজ পড়া হয় মূলত তা হচ্ছে তারাবিহ নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা) নিজে তারাবিহ নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবিহ নামাজ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
এ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা বেশি সওয়াবের কাজ। কোরআন শরিফ খতম করার মাধ্যমে এ নামাজ আদায় করা আরো অধিক সওয়াবের কাজ। তবে সূরা-ক্বিরাআতের মাধ্যমে আদায় করলেও তারাবিহ নামাজ আদায় হবে এবং পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। ক্বোরআন মজিদে মোট ৫৪০টি রুকু রয়েছে যা তারাবিহ নামাজে প্রতিদিন ২০ রাকাতে ২০ রুকু করে পড়লে ২৭ রামাদ্বান তথা লাইলাতুল ক্বদরে পবিত্র কোরআনের সম্পূর্ণটুকু তিলাওয়াত করা সমাপ্ত হয় অর্থাৎ খতম শেষ হয়।
তারাবিহ নামাজ কি
রামাদ্বান মাসের রাতে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নাতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে ‘তারাবিহ নামাজ’ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ যার অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। শরিয়তের পরিভাষায় মাহে রামাদ্বানে তারাবিহ নামাজ আদায়কালীন সময়ে প্রতি দুই রাকাত অথবা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবিহ’।
রামাদ্বান মাসে সালাতুত তাসবিহ পড়া শিখতে ভিজিট করুন
তারাবিহ নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা
তারাবিহ নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করেন, তাঁর অতীতে কৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রোজা রাখেন, তারাবিহ নামাজ পড়েন এবং ক্বদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের আগের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত সাঈর ইবনে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদ্বানের রাতের (তারাবিহতে) নামাজে শত শত (শ’-এর ওপর) আয়াত পড়তেন। ফলে সুদীর্ঘ সময় দাঁড়ানোর কারণে আমরা লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। (মুয়াত্তা মুহাম্মদ)
তারাবিহ নামাজের নিয়ত-
তারাবিহ নামাজ দুই দুই রাকাআত করে পড়া যায়; আবার এক সঙ্গে ৪ রাকাআতও পড়া যায়। যেহেতু তারাবিহ নামাজ লম্বা ক্বিরাতে পড়া উত্তম। তাই দুই দুই রাকআত করে ধীর স্থিরভাবে পড়াই উত্তম। তারাবিহ নামাজ আদায়ের সময় আরবি অথবা বাংলায় নিয়ত করলেও হবে।
আরবি নিয়ত-
উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা, রাকাআতাই সালাতিত তারাবিহ সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআলা, (ইক্বতাদাইতু বিহাজাল ইমাম) মুতাওয়াঝঝিহান ইলা ঝিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার। (ইমামের পিছনে নামাজ পড়লে বন্ধনীর অংশটুকুসহ পড়তে হবে)
বাংলায় নিয়ত
তারাবির দুই রাকাআত সুন্নাত নামাজ (এই ইমামের সঙ্গে) কিবলামুখী হয়ে আল্লাহ তাআলার জন্য আদায় করার নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার।
চার রাকাআ’ত পরপর দোয়া
তারাবিহ নামাজের ৪ রাকআত পর পর বহুল প্রচলিত একটি দোয়া আছে। যা তুলে ধরা হলো- দুআ’টি হলো-
উচ্চারণ: সুবহানাযিল মুলকি, ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাযিল ইজ্জাতি, ওয়াল আয্মাতি, ওয়াল হাইবাতি, ওয়াল ক্বুদরাতি, ওয়াল কিবরিয়া-ই, ওয়াল যাবারুত। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা-ইয়ানামু, ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা, সুব্বুহুন, ক্বুদ্দুছুন, রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি, ওয়ার রূহ।
তারাবিহ শেষে মুনাজাত
তারাবিহ নামাজ শেষ হলে সবাই সমবেতভাবে একটি মুনাজাত করে থাকেন। আবার অনেকে একাকি মুনাজাত করেন। এ মুনাজাত সমবেত হোক আর একাকি হোক করা যেতে পারে।
মনের একান্ত কথাগুলো যেভাবে ইচ্ছা আল্লাহর কাছে তুলে ধরায় কোনো অসুবিধা নেই। তারাবিহ নামাজ শেষে যে প্রচলিত দোয়া আমরা পড়ে থাকি তা হলো-
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ – اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা, ওয়া নাউজুবিকা মিনান্নার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বি-রাহমাতিকা ইয়া আজিজু, ইয়া গাফফারু, ইয়া কারিমু, ইয়া সাত্তারু, ইয়া রাহিমু, ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিকু, ইয়া বার। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বি-রাহমাতিকা ইয়া আর-হামার রাহিমীন।’
প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব
প্রশ্ন: করোনা ভাইরাস এড়াতে সরকার মসজিদে জামাতে তারাবিহ এর নামাজ পড়া বন্ধ ঘোষণা করেছে, এক্ষেত্রে বাড়ীতে কিভাবে নামাজ আদায় করব?
উত্তর: নিজ দেশের সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কাজেই মসজিদে জামাতে তারাবিহ পড়া যাবে না। এক্ষেত্রে বাড়ীতে নিজে নিজেরাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জামাতে তারাবিহ পড়া যাবে।
যেমন- বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, সবাই একসাথে জামাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করবেন। নিয়ম হল- পুরুষরা আগে দাঁড়াবেন আর মহিলারা পেছনে দাঁড়াবেন।
যদি পুরুষ লোক ২ জন আর মহিলা ২ জন হন তাহলে দুইজন পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়াবেন এক্ষেত্রে ইমাম একটু সামনে দাঁড়াবেন আর দুইজন মহিলা তাদের পেছনে দাঁড়াবেন। পুরুষ-মহিলা পাশাপাশি দাঁড়ানো যাবে না।
প্রশ্ন: যদি কয়েকটি পরিবার একত্রে জামাত পড়তে চাই তাহলে নিয়ম কি?
উত্তর: কয়েক পরিবার একত্রে জামাতে তারাবিহ আদায়ের ক্ষেত্রে মহিলাদের জড়িত করার দরকার নেই। এতে ফিৎনা সৃষ্টির সম্ভবনা থাকে। তাই যিনি ভাল সূরা-ক্বিরাত জানেন তার ইমামতিতে সবাই একত্রে জামাতে তারবিহ পড়তে পারেন।
প্রশ্ন: তারাবিহ নামাজ কত রাকাত?
উত্তর: হানাফি, শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের মতে তারাবিহ নামাজ ২০ রাকআত। মালিকী মাযহাবের মতে, তারাবিহ নামাজ ৩৬ রাকআত এবং আহলে হাদীসরা ৮ রাকআত তারাবিহ পড়ে থাকেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: হযরত উমর (রা) এর খিলাফতকালে ২০ রাকাআত তারাবিহ নামাজ জামাতের সাথে সকল সাহাবীদেরকে সাথে করে নিয়ে আদায় করতেন। কাজেই এই নামাজ ২০ রাকাতের কম পড়া উচিত হবে না।
৮ রাকাত তারাবিহের নামাজ আদায়ের যে হাদিস হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সেই বর্ণনাকারী নিজেও হযরত উমর (রা) এর পেছনে জামাতের সাথে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি হযরত আয়েশা (রা) ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত ২০ রাকাত নামাজই আদায় করেছেন।
প্রশ্ন: তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল?
উত্তর: তারাবির নামায নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
প্রশ্ন: খতম তারাবীহ এবং সূরা তারাবীহ কি?
উত্তর: বাংলাদেশে তারাবিহ নামাজের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত। একটি খতম তারাবিহ আর অন্যটি সূরা তারাবিহ। খতম তারাবিহ এর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করা হয়। খতম তারাবিহ এর জন্য কুরআনের হাফিযগণ ইমামতি করেন। সূরা তারাবিহ এর জন্য যেকোন সূরা বা আয়াত পাঠের মাধ্যমে সূরা তারাবিহ আদায় করা হয়।
তারাবিহ নামাজের আরাবি নিয়্যাত মাওলানা লুৎফুর রহমান
গোটা রামাদ্বান মাসজুড়ে নিচের দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়তে পারেন-
اَﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺇﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗُﺤِﺐُّ اﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আ’ন্নি।
– তাছাড়া তারাবিহ নামাজের পর সাইয়্যিদুল ইসতেগফারও পড়া যেতে পারে-
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
আল্লাহপাক যেন আমাদেরকে তারাবিহ নামাজ পড়ার নিয়ম ভালভাবে শেখার তাওফিক দান করেন, আমীন!!!
ভাল নোট তৈরি করার কৌশল জানতে ভিজিট করুন
মো: নজরুল ইসলাম, ০১৭১৬-৩৮৬৯৫৮