ঋণ আদায়ের আমল আমালিয়াত ১ম খন্ড, ৪র্থ অধ্যায়, ১ম পর্ব থেকে নেয়া হয়েছে। এই ঋণ আদায়ের আমল সমূহে রয়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত কিতাব হতে পরীক্ষিত সকল তদবির। আশা করি পাঠকদের উপকারে আসবে।
লেখক: হযরত মাওলানা ক্বারী মো: নজরুল ইসলাস সাহেব, ভাদেশ্বরী। (এমএম, এমএ)
চতুর্থ অধ্যায় ১ম পর্ব শুরু
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সময়ের স্বল্পতাহেতু সকল আয়াত বা বাক্যের হরকত দেয়া সম্ভব হয়নি।
ইনশাহ আল্লাহ ধীরে ধীরে প্রতিটি আয়াত বা বাক্যের হরকত সংযোজন করা হবে তথা যের, যবর, পেশ সংযোজন করা হবে। তাই আপডেট পেতে সাথে থাকুন।
ঋণ আদায়ের আমল বর্ণনার আগে ঋণ কি এ সম্পর্কে আলোকপাত কবর।
ঋণ বা কর্জ
ঋণ বা কর্জ মানুষের তথা সমাজের একটি প্রয়োজনীয় লেনদেন। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন-যাপন করার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় ঋণ নেওয়ার কিংবা অন্যকে ঋণ দেয়ার সম্মুখীন হতে হয়।
তবে এই মানবীয় সুন্দর নিয়ম এবং অপরকে সহযোগিতা করার এই ইসলামী প্রথাটি অনেক সময় কুমতলবীদের চক্রান্তে ও মায়াজালে ফেঁসে গিয়ে বিদ্বেষ, ঝগড়া-ঝাঁটি এমনকি বড় রকমের শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অনেকে এই ঋণ প্রথাকেই পুঁজি করে বিশ্বে হারাম পথে বিশাল টাকা ইনকাম করেছে ও করছে। আর দরিদ্র সম্প্রদায় তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে ঋণের জাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে।
আমরা এই প্রবন্ধে ইসলামে ঋণের বিধি-বিধান সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এবং কোন কোন আমল করলে ঋণ পরিশোধ সহজ হয় সেই আমলগুলো আলোচনা করব। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
ঋণের অর্থ
ঋণের আরবী শব্দ হচ্ছে قرض যা প্রচলিত বাংলা ভাষায় কর্জ নামে পরিচিত। এর বাংলা সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে- দেনা, ধার, হাওলাদ ইত্যাদি।
শরীয়তের পরিভাষায় ঋণ
মুদ্রা, মাল বা পণ্য অপরকে প্রদান করা যেন তার মাধ্যমে সে উপকৃত হয়। অতঃপর দাতাকে সেই মাল কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া। [ফিক্হ বিশ্বকোষ, খন্ড ৩৩, পৃঃ১১১]
ঋণের বৈধতা
ঋণ প্রথা বৈধ যা সুন্নত এবং ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৬/৪২৯]
নবী (সাঃ) একদা এক উষ্ট্রী ধার নেন এবং ফেরত দেয়ার সময় সেই সমগুণের উষ্ট্রী না পাওয়ায় তার থেকে উত্তম গুণের পুরুষ উট ফেরত দেন এবং বলেন- “তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে উত্তম ঋণ পরিশোধকারী।’’ [বুখারী ,অধ্যায়,ইস্তিকরায, নং২৩৯০]
ঋণ প্রদানের ফযীলত
ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। এর মাধ্যমে লোকের সাহায্য করা হয়, তাদের প্রতি দয়া করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হ্রাস করা হয় কিংবা সমাধান করা হয়।
নবী (সাঃ) বলেন-
‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার আখেরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতকে সহজ করবেন। আল্লাহ তা’য়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত তার বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।”
[মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর, দুআ, তাওবাহ ও ইস্তিগফার]
নবী (সাঃ) আরো বলেন-
‘‘যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুই বার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী এক বার সাদাকা করার মত।’’
[ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান, ইরওয়াউল গালীল নং ১৩৮৯]
ঋণ লেন-দেনে মেয়াদ নির্ধারণ
বিষয়টির ব্যাখ্যা হচ্ছে, ঋণ দাতা এবং ঋণ গ্রহীতা লেন-দেনের সময় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারে কি পারে না?
সঠিক মত হচ্ছে, মেয়াদ নির্ধারিত করতে পারে এবং প্রয়োজনে মেয়াদ বৃদ্ধিও করতে পারে।
৩০টি দ্রব্যগুণন যাদু ও টোটকা বিদ্যা শিখতে ভিজিট করুন
কারণ আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে।”
[সূরা বাকারাহ – ২৮২]
অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ ফেরত নেয়ার দাবী করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য।
কেননা নবী (সাঃ) বলেন-
‘‘মুসলিমগণ শর্ত পূরণে বদ্ধপরিকর।” [আহমদ,আবু দাউদ,তিরমিযী]
ঋণের মাধ্যমে লাভ অর্জন
ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে সাহায্য করা, তাদের প্রতি দয়া করা তথা তাদের জীবন-যাপনে সহযোগিতা করা, সহযোগিতার আড়ালে সুবিধা অর্জন করা নয়।
তাই বলা হয়েছে, ঋণের উদ্দেশ্য হবে আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি বাহ্যিক বৃদ্ধি নয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই কারণে ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা কিংবা সেই অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট, অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে কিংবা ঋণ গ্রহীতা অতিরিক্ত ফেরত দিলে, তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ ফিক্হী মূলণীতিতে উল্লেখ হয়েছে,
كل قرض جرّ نفعا فهو ربا
উচ্চারণ- ‘কুল্লু কার্যিন জার্রান নাফ্আন ফাহুআ রিবা।
অর্থ- প্রত্যেক ঋণ, যার মাধ্যমে লাভ উপার্জিত হয়, তা সুদ। আর এই হাদিসটি দুর্বল হওয়া সত্বেও কায়েদায়ে ফিকহিয়্যাহর মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত।
ইসলামে উত্তম ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থা এবং বর্তমান ব্যাংকিং প্রথা, একটি সংশয় নিরসন-
ইসলাম ঋণ দেওয়াকে যেমন লোকের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণ হিসেবে স্বীকার করে, তেমন ঋণ পরিশোধে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করে। তাই ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় বেশি বা উত্তম ফেরত দিতে পারে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘হুসনুল্ কাযা’ বা উত্তম পরিশোধ বলা হয়।
অনেকে ইসলামের এই সুন্দর বিধান না বুঝতে পেরে, কিংবা না বোঝার ভান করে, কিংবা অপরিপক্ক জ্ঞানের কারণে কিংবা অন্তরে প্রবৃত্তির রোগ থাকার কারণে, বিষয়টিকে বর্তমান ব্যাংকিং প্রথায় অতিরিক্ত প্রদান করা ও অতিরিক্ত গ্রহণ করা বৈধ বলে ফতুয়া দিয়ে থাকে। এটা কখনো সঠিক নয়।
তাদের মন্তব্য হল, নবী (সাঃ) যেমন ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় বেশি দিলেন এবং ঋণ দাতা ফেরত নেয়ার সময় বেশি গ্রহণ করলেন, তেমন আমরা ব্যাংকে ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় যদি বেশি দেই এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেটা গ্রহণ করে তো অবৈধতার কিছু নেই।
এর উত্তরে বলবো, নবী (সাঃ) এর ঋণ ফেরতে বেশি দেওয়া এবং বর্তমান যুগের ব্যাংকিং প্রথায় বেশী লেন-দেনের প্রথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।
প্রথমতঃ নবী (সাঃ) কে ঋণ দাতা ঋণ প্রদানের সময় কোনো শর্ত দেয়নি যে, ঋণ ফেরত কালে বেশি ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান ব্যাংক সুক্ষ্ণ হিসেবের মাধ্যমে বেশি দেওয়ার শতকরা হার নির্ধারণ করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ে তা ফেরত না দিতে পারলে শতকরা হার চক্রবৃত্তি হারে আরোও বৃদ্ধি পায়। আসলে ব্যাংক এই চক্রের মাধ্যমেই অর্থায়ন করে থাকে, আর আমরা বুঝেও বুঝি না বা না বুঝার ভান করি।
দ্বিতীয়তঃ সমাজে এটা পরিচিত ছিল না যে, নবী (সাঃ) কে ঋণ দিলে তিনি অতিরিক্ত ফেরত দেন। বরং তিনি হঠাতই এই রকম আদেশ দেন। এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণের ঐক্যমত রয়েছে যে, যে কোনো ঋণে যদি বেশি ফেরতের শর্ত থাকে, তাহলে সেটা হারাম।
ইবনুল মুনযির বলেন-
‘তাদের ঐক্যমত রয়েছে যে, ঋণ দাতা যদি ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ ফেরতের সময় বেশি দেওয়া কিংবা হাদিয়াসহ ঋণ ফেরত দেওয়ার শর্ত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে বেশি নেওয়াটা সুদ।’ [মুগনী,৬/৪৩৬]
ঋণ পরিশোধে বিলম্ব না করা
ঋণ দাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণ গ্রহীতার দ্বীনী ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া। যদি এইরকম না করে টাল-বাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর পেশ করতে লাগে, তাহলেই আপসে মিল-মুহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়, শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
মহান আল্লাহ বলেন-
“উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরষ্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?” [সূরা আর রাহমান – ৬০]
তিনি অন্যত্রে বলেন-
إن الله يأمركم أن تؤدوا الأمانات إلى أهلها
অর্থ- নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে। [ সূরা নিসা – ৫৮]
নবী (সাঃ) বলেন-
“ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করা অত্যাচার।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি]
তিনি (সাঃ) আরো বলেন-
من فارق الروح الجسد، و هو بريء من ثلاث دخل الجنة: من الكبر، والغلول، والدين – رواه ابن ماجه
অর্থ- যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাহলো-
১. অহংকার,
২. গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং
৩. ঋণ।”
[ইবনু মাজাহ, হাদিসটিকে আলবানী (রহঃ) সহীহ বলেছেন]
অভাবী ঋণীকে অবকাশ প্রদান
সমাজে যেমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে ঢিলেমি করে, তেমন সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এই রকম ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
و إن كان ذو عُسرة فنظرة إلى ميسرة و أن تصدقوا خيرٌ لكم إن كنتم تعلمون٠
“যদি ঋণী দরিদ্র হয়, তবে স্বচ্ছল অবস্থা আসা পর্যন্ত অবকাশ দিবে আর মাফ করে দেয়া তোমাদের পক্ষে অতি উত্তম হবে, যদি তোমরা জানতে!”
[ সূরা বাক্বারাহ – ২৮০]
নবী (সাঃ) বলেন-
‘‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আল্লাহ তাকে কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দিবে, সে যেন অভাবী ঋনীকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণের বোঝা লাঘব করে।” [মুসলিম, অধ্যায়- ক্রয়-বিক্রয়, নং ৪০০০]
এখানে একটি বিষয় বর্ণনা করা জরূরী মনে করছি, তা হল, ঋণ গ্রহীতা যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পারে, তাহলে তাকে অবকাশ দিতে হবে বিনা লাভের শর্তে। কিন্তু যদি ঋণ দাতা তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে লাভ নেয় তাহলে তা স্পষ্ট সুদ হবে। এমনটা করা যাবে না।
ঋণ পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ
আজ-কাল সমাজে আরো এক প্রকার লোক দেখা যায়, যারা ঋণ নেয় পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ আসলে তার অন্তরে থাকে অন্যের অর্থ কৌশলে আত্মসাত করা। আর ঋণ করাটা হচ্ছে তার একটি বাহানা মাত্র। ঋণ আদায়ের আমল
নবী (সাঃ) বলেন-
من أخذ أموال الناس يريد أداءها أدى الله عنه، و من أخذ يريد إتلافها أتلفه الله –رواه البخاري
অর্থ- যে ব্যক্তি অন্যের মাল পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা’য়ালা তার পক্ষ হতে তা পরিশোধ করে দেন। (পরিশোধ করতে সাহায্য করেন) আর যে ব্যক্তি তা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা নষ্ট করে দেন। [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং২৩৮৭] ঋণ আদায়ের আমল এর বাকী অংশ পরবর্তী পর্বে থাকবে
অনলাইনে একদম ফ্রি পদ্ধতিতে ইনকাম করা জানতে ভিজিট করুন
(৪র্থ অধ্যায়, ১ম পর্ব সমাপ্ত)
(২য় পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন)
যোগাযোগ: ০১৭১৬-৩৮৬৯৫৮, Email: nazruld@yahoo.com