হযরত ইয়াকুব বদরপুরী (রহ) হলেন উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ট আলেমে দ্বীন ও আল্লাহর ওলী। হযরত ইয়াকুব বদরপুরী (রহ) এর সংক্ষিপ্তভাবে পাঠক সমাজে তুলে ধরছি।
কুতবুল আকতাব হযরত শাহ মুহাম্মদ ইয়াকূব বদরপুরী ছাহেব ক্বিবলাহ (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
বংশ পরিচয়, শুভ জন্ম শৈশব
অনেক আগে দিল্লীর কোন এক সুলতান মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত দুর্গসমূহের যে দুর্গটি পুরাতন সিলেট জেলার (বর্তমানে কাছাড় জেলার) বদরপুরের পুরান বাজারের কাছে নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেই দুর্গের জন্য দিল্লীর অধিবাসী চারজন সম্ভ্রান্ত শেখ, সৈয়দ, মোগল ও পাঠান বংশীয় সামরিক কর্মকর্তা প্র্রেরণ করেন। অবশেষ তাঁদের পরবর্তী বংশধরেরা বদরপুর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তন্মধ্যে শেখ বংশীয় সামরিক কর্মকর্তার বংশধরেরা বদরপুরের বুন্দাশীল নামক গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। তাঁরাই কুতবুল আকতাব হযরত শাহ মুহাম্মদ ইয়াকূব বদরপুরী (রঃ) এর পূর্ববর্তী বংশধর। তাঁর পিতা এই খান্দানের একজন নামকরা লোক শাহ মুহাম্মদ বাছির ছিলেন। শৈশবেই তিনি পিতা মাতাকে হারান এবং তাঁর মামার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন।
শিক্ষা জীবন
তাঁহার প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ “বাগবাড়ী” নিবাসী মাওলানা নজিব আলী মরহুমের কাছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর যথাক্রমে তিনি মাদ্রাসাই আলিয়া ফুলবাড়ী ও মাদ্রাসাই আলিয়া কটকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর ভারতবর্ষের ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মাদ্রাসাই আলিয়া রামপুরে চলিয়া যান এবং সেখানে হযরত মাওলানা ফজলে ইর্শাদ হুসেইন রামপুরী (রঃ) প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের কাছে দওরায়ে হাদিছসহ অন্যান্য বিষয়ে চূড়ান্ত শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
বয়েত ও খিলাফত জীবন
বাল্যকাল হইতেই তাঁহার হৃদয়ে ধ্যান ধারণার প্রেরণা ও আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা পরিলক্ষিত হয়। বাহ্যিক ইলম আয়ত্ত্ব করার পর তিনি মুর্শিদের সন্ধানে ছিলেন। তবে তিনি এই অনুসন্ধানে বাহ্যিক চেষ্টার চেয়ে আল্লাহর তরফ হইতে কোন ইঙ্গিত প্রাপ্তির উপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। এই অনুসন্ধিৎসু মন লইয়া তিনি এক রাত্রিতে স্বপ্ন দেখিলেন হযরত মাওলানা হাফিজ আহমদ (রঃ) তাঁহাকে আহ্বান করিতেছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনখানে আপনার সাক্ষাৎ পাইব?” উত্তরে জৌনপুরী (রঃ) বলিলেন, “কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর নামক স্থানে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করুন। ” স্বপ্ন দেখার পরদিন হযরত বদরপুরী (রঃ) চাঁদপুর পৌঁছিলেন। এইদিকে কুতবুল ইর্শাদ হযরত মাওলানা জৌনপুরী (রঃ) তিন দিন হইতে তাঁহার অপেক্ষা করিতে ছিলেন। তিনি খাদিমদিগকে বিশেষভাবে বলিয়া রাখিয়াছিলেন, “যদি সিলেট হইতে কোন আলিম সাহেব আসিয়া থাকেন তবে সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে পৌঁছাইয়া দিবে।”
বদরপুরী সাহেব চাঁদপুর স্টেশনে গাড়ী হইতে নামার পর অনেক প্রশ্ন করিলেন, আপনার বাড়ী কোন জায়গায়? তিনি উত্তরে বলিলেন, “আমি সিলেট হইতে আসিয়াছি।” তাহারা উত্তর শুনিয়া বলিলেন “হুযুর কিবলাহ তিন দিন হইতে আপনার অপেক্ষায় আছেন।” বদপুরী সাহেব তাহাদের কথায় বিস্মিত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন হুযুর কিবলাহ তো আমাকে চিনেনই না তবে কার অপেক্ষা করিতেছেন? যাহাই হোক, তিনি জৌনপুরী সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হইলেন। জৌনপুরী (রঃ) তাঁহাকে তিনবার প্রশ্ন করিলেন, “আপনি কি চান? বদরপুরী (রঃ) তিনবারই উত্তরে বলিলেন “আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি আমার কাম্য।” তারপর জৌনপুরী (রঃ) তাঁহাকে বয়েত করাইলেন। তাঁহাকে দুই দিনের তরীকার ছবকসমূহ বাতাইয়া দিলেন এবং মকামে ফানা, বাকা, মাশাহেদা ইত্যাদি স্তর অতিক্রম করাইয়া দিলেন। তারপর খিলাফত নামা প্রদান করিলেন। তখন বদরপুরী সাহেব তাঁহার কাছে কিছুদিন থাকার জন্য কাঁদিয়া কাঁদিয়া অনুনয় বিনয় আরম্ভ করিলেন। তখন পীরে কামিল হযরত মাওলানা হাফিজ আহমদ (রঃ) জযবার মধ্যে আসিয়া বদরপুরী সাহেবের বুকে সজোরে স্বীয় আংটি দ্বারা চাপ প্রয়োগ করিয়া বলিলেন, “আপনার খেদমতের আর প্রয়োজন নাই। ইনশা আল্লাহ সবকিছু হইয়া যাইবে।” তারপর বদরপুরী (রঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুনরায় কোন জায়গায় যাইয়া সাক্ষাৎ করিব।” তখন জৌনপুরী (রঃ) বলিলেন, “আর দেখা হইবে না।” আল্লাহর নেক বান্দারা যাহা বলিয়া থাকেন ঠিকই বলিয়া থাকেন। কথাটা বাস্তবিকই সত্য। এই দিনেই তিনি বদরপুরী সাহেবকে বিদায় দিয়া ঢাকার পথে রওয়ানা হন এবং সফরেই ইন্তিকাল করেন। বদরপুরী সাহেব প্রায়ই বলিতেন, “হযরত মাওলানা জৌনপুরীর (রঃ) আমার বুকে আংটি দ্বারা চাপ প্রয়োগের সময় যে উষ্ণতা অনুভব করিয়াছিলাম এখনও তাহা আছে।” এই উষ্ণতা তাঁহার মৃত্যুর পরও বাকি ছিল। তাঁহার বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মাহমুদুর রহমান সাহেব যিনি তাঁহাকে গোসল দিবার সময় উপস্থিত ছিলেন, বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাঁহাকে ইন্তেকালের প্রায় আঠারো ঘণ্টা পর গোসল দেওয়া হয়। গোসলের সময় শরীরে হাত দিয়া দেখিলাম শরীর স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা কিন্তু বুক হইতে কোমর পর্যন্ত এত গরম যে, মনে হইতেছিল যেন জ্বর উঠিয়াছে।
ইলমে দ্বীনের খেদমত
তিনি কাছাড়ের কাঠিগড়া মাদ্রাসা, আসামের জয়নগর মাদ্রাসা ও মাদ্রাসাই আলিয়া বদরপুরে দীর্ঘ দিন নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনি শিক্ষাদানে মশগুল থাকেন। তিনি মাদ্রাসাই আলিয়া বদরপুর ও দারুল হাদিছের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাছাড়া অন্যান্য বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও স্থায়িত্ব তাঁহার উপর নির্ভর করিত। তাঁহার আদেশে বহু মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। জ্ঞানী মনীষীদের মহান উক্তিসমূহ পড়তে ভিজিট করুন
তাবলীগ ও ইর্শাদ
তিনি হযরত মাওলানা জৌনপুরী সাহেবের খেদমত হইতে বিদায় লইয়া দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মানুষের কাছে স্বীয় রহস্য গোপন রাখার চেষ্টা করেন কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই মানুষের কাছে প্রকৃত বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে। দলে দলে লোক তাঁহার কাছে বয়েত করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে থাকে। তিনি আজীবন তাবলীগ ও হেদায়তের কাজে মশগুল থাকেন। সিলেট, কাছাড় ও নওয়াগাঁও জেলার বহু লোক তাঁহার কাছে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। তাছাড়া গোয়াল পাড়া ডিব্রোগড়, ডিগবই, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় তাঁহার বহু মুরীদ ছিলেন। উপরোক্ত অঞ্চলসমূহের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম তাঁহার ছিলছিলা ভুক্ত ছিলেন। তাঁহার খলিফাগণের দ্বারা দ্বীনি খেদমত ও ছিলছিলার খেদমত জারী আছে। বাংলাদেশের খলিফাগণের মধ্যে তাঁহার জামাতা ও তাঁহার স্থলাভিষিক্ত খলিফা রঈছুল কুররা ও রঈছুল মুফাচ্ছিরীন জনাব মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেবের দ্বারা মানুষের হেদায়ত, ইলমে দ্বীন ও তরীকতের খেদমত, বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ইত্যাদি জারী আছে।
আখলাক
তিনি সব প্রশংসনীয় গুণে গুণান্বিত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে পূর্ণ আদর্শবান ছিলেন। বিশেষতঃ দানশীলতা, মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শন তাঁহার চরিত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। তাই লোক তাঁহাকে হাতীম আখ্যা দিয়াছিল। পবিত্র কুরআনের সাথে তাঁহার হৃদয় অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। তিনি শুদ্ধভাবে তাজবীদ মত কোরান শরীফ পাঠ করার বিশেষ তাগিদ করিতেন। দুরূদ ও অযীফার অভ্যাস কোন দিন ছাড়িতেন না।
শেষ বিদায়
তিনি ১৩৬৩ বাংলার ৬ই মাঘ সোমবার দিন তাঁহার জন্মস্থান বুন্দাশীল বদরপুরে ইন্তেকাল করেন এবং নিজ মহল্লার মসজিদের পাশে সমাহিত হন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ছিল ১০৪ বৎসর।
[তথ্যসূত্র: মুনাজাতে ইয়াকুবী, পৃষ্টা: ৪০-৪২]
ইন্তেকালের সঠিক তারিখ
১৩৭৭ হিজরীর জমাদিউস সানী মাসের ২৯ তারিখ ১৯৫৮ ইংরেজীর ১৯শে জানুয়ারী। হযরত ইয়াকুব বদরপুরী (রহ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী সমাপ্ত।
[সূত্র: হযরত মাওলানা হাফিজ আহমদ জৌনপুরী (র), পৃষ্টা- ৭৫-৭৯]
আয়াতে শিফার আমল আর তদবির জানতে ভিজিট করুন