মৃত ব্যক্তির গোসল দেয়া ওয়ারিশদের জন্য ফরজে কেফায়া। কাজেই মৃত ব্যক্তির গোসল সম্পর্কে জানা আবশ্যক। আজকে আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানব।আশা করি পাঠকদের উপকারে লাগবে।
মৃত ব্যক্তির গোসল করানোর নিয়ম
মৃত ব্যক্তির গোসল দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম
সেই ব্যক্তিই হকদার, যার ব্যাপারে মৃত ব্যক্তি ওছিয়ত করে গেছেন। তারপর তার পিতা। তারপর অপরাপর নিকটাত্মীয়। আর মহিলার গোসলে প্রথম হকদার হল তার ওছিয়তকৃত মহিলা। তারপর তার মা। তারপর তার মেয়ে। তারপর অন্যান্য নিকটাত্মীয় মহিলাগণ।
অনলাইনে ইনকাম করা সম্পর্কে জানতে ভিজিট করুন
মৃত ব্যক্তি নারী হোক বা পুরুষ তার বয়স যদি সাত বছরের কম হয়, তবে যে কোন পুরুষ বা মহিলা তার গোসল দিতে পারবে। গোসলের জন্য পুরুষের ক্ষেত্রে পুরুষ আর নারীর ক্ষেত্রে নারী যদি না পাওয়া যায় তবে তার গোসল দিবে না। বরং তাকে তায়াম্মুম করিয়ে দিবে। এর পদ্ধতি হল, উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন তার হাত দুটি পাক মাটিতে মারবে। তারপর তা দ্বারা মৃতের মুখমন্ডল ও উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত মাসেহ করে (মুছে) দিবে।
কোন কাফেরকে গোসল দেয়া এবং দাফন করা মুসলমানের উপর হারাম। আল্লাহ্ বলেন- (ﻭﻻَ ﺗُﺼَﻞِّ ﻋَﻠﻰَ ﺃﺣَﺪٍ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﻣﺎَﺕَ ﺃﺑَﺪﺍً) “আপনি তাদের (কাফের মুনাফেকদের) উপর কখনই জানাযা সালাত আদায় করবেন না।” (তওবাহ্- ৪৮)
গোসল দেয়ার সুন্নাত তরিকা হল, প্রথমে তার লজ্জাস্থান ঢেঁকে দেবে, তারপর তার সমস্ত কাপড় খুলে নিবে। অত:পর তার মাথাটা বসার মত করে উপরের দিকে উঠাবে এবং আস্তে করে পেটে চাপ দিবে, যাতে করে পেটের ময়লা বেরিয়ে যায়। এরপর বেশি করে পানি ঢেলে তা পরিস্কার করে নিবে। তারপর হাতে কাপড় জড়িয়ে বা হাত মুজা পরে তা দিয়ে উভয় লজ্জা স্থানকে (না তাকিয়ে) ধৌত করবে। তারপর ‘বিসমিল্লাহ্’ বলবে এবং সালাতের ন্যায় ওযু করাবে। তবে মুখে ও নাকে পানি প্রবেশ করাবে না। বরং ভিজা কাপড় আঙ্গুলে জড়িয়ে তা দিয়ে তার উভয় ঠোঁটের ভিতরের অংশ ও দাঁত পরিস্কার করবে। একইভাবে নাকের ভিতরও পরিস্কার করবে।
পানিতে কুল পাতা মিশিয়ে গোসল দেয়া মুস্তাহাব। প্রথমে ডান সাইডের সামনের দিক ও পিছন দিক ধৌত করবে। তারপর বাম দিক ধৌত করবে। এভাবে তিনবার গোসল দিবে। প্রতিবার হালকা ভাবে পেটে হাত বুলাবে এবং ময়লা কিছু বের হলে পরিস্কার করে নিবে। গোসলের সময় সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন মোতাবেক তিনবারের বেশি সাত বা ততোধিক বার গোসল দেয়া যাবে। শেষবার কর্পুর মিশ্রিত করে গোসল দেয়া সুন্নাত। কেননা নবী (সা) তাঁর কন্যা যায়নাবের (রা) শেষ গোসলে কর্পুর মিশ্রিত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
মৃতের মোচ বা নখ যদি বেশি বড় থাকে তবে তা কেটে দেয়া মুস্তাহাব। তবে বগল বা নাভীর নীচের চুল কাটা যাবে না। সাত বার গোসল দেয়ার পরও যদি পেট থেকে ময়লা (পেশাব বা পায়খানা) বের হতেই থাকে তবে উক্ত স্থান ধুয়ে সেখানে তুলা বা কাপড় জড়িয়ে দিবে। তারপর তাকে ওযু করাবে। কাফন পরানোর পরও যদি ময়লা বের হয়, তবে আর গোসল না দিয়ে সেভাবেই রেখে দিবে। কেননা তা অসুবিধার ব্যাপার। মৃতের চুল আঁচড়ানোর দরকার নেই। তবে নারীর ক্ষেত্রে তার চুলগুলোতে তিনটি বেণী বেঁধে তা পিছনে ছড়িয়ে দিবে। হজ্জ বা ওমরায় গিয়ে ইহরাম অবস্থায় যদি কেউ মারা যায়, তবে তাকে কুল পাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল দিবে। কিন্তু কোন সুগন্ধি ব্যবহার করবে না এবং পুরুষ হলে কাফনের সময় তার মাথা ঢাঁকবে না। বিদায় হজ্জে জনৈক ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে নবী (সা) বলেন- “তাকে কোন সুগন্ধি লাগাবে না, এবং তার মাথা ঢাঁকবে না। কেননা সে ক্বিয়ামত দিবসে তালবিয়া পাঠ করতে করতে উত্থিত হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
ধর্ম যুদ্ধে শহীদ ব্যক্তিকে গোসল দিবে না এবং তাকে তার সাথে সংশ্লিষ্ট কাপড়েই দাফন করবে। কেননা নবী (সা) “ওহুদের শহীদদের ব্যাপারে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাদেরকে গোসল ছাড়া তাদের পরিহিত কাপড়ে দাফন করা হবে।” (বুখারী)
মৃত ব্যক্তি আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারণে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খন্ড-বিখন্ড হওয়ার কারণে বা পানি না পাওয়ার কারণে যদি তাকে গোসল দেয়া সম্ভব না হয়, তবে পূর্ব নিয়মে তাকে তায়াম্মুম করিয়ে দিতে হয়।
মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের ফরযসমুহ
মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার ওয়ারিশদের উপর চারটি কাজ ফরয হয়ে পড়ে। (ফরযে কেয়ায়া) যথা-
১) মৃতকে গোসল দেওয়া।
২) কাফন পড়ানো।
৩) জানাযার নামায পড়া।
৪) দাফন করা।
মৃতের গোসলের বিবরণ
মাইয়্যেতকে একখানা টিন, তক্তা অথবা চৌকির উপরে
শোয়াইয়া একখানা কাপড় দ্বারা নাভী পাঁটু পর্যন্ত ঢাকিয়া দিবে। শরীরের অন্যান্য কাপড় চোপড় খুলিয়া লইবে। তারপর বড়ই পাতা এবং কর্পুর মেশানোর গরম পানি বা শুধু কর্পুর মিশানোর গরম পানি দ্বারা গোসল করাতে আরম্ভ করিব। গোসল করাইবার সময় পর্দার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিবে। একটি মশারী খাটাইয়া তার মধ্যে লাশ রাখিয়া সর্ব সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে গোসল কারাইবে। মৃতকে গোসলের সময় উত্তর শিয়রি করিয়া লইবে। তারপর গোসল দাতা হাতে একখানা নেকড়া জড়াইয়া সর্বপ্রথম মৃতের গুপ্তস্থানসমূহ ধৌত করাইবে এবং আস্তে আস্তে পেট মর্দ্দন করিবে। ইহাতে নাভী হইতে বা মলমুত্র পথে কোন নাপাক বস্তু বাহির হইলে তাহা ধুইয়া ফেলিবে। তারপর মৃতকে অযু করাইবে (মৃত পাগল বা নাবালেগ হইলে অযু করাইতে হয় না)। অযুতে কুলি করাইতে বা নাকের মধ্যে পানি পৌঁছাতে হয় না। তার পরিবর্তে ভিজা নেকড়া দ্বারা মুখ ও নাসিকার অভ্যন্তর মুছিয়া ফেলিবে। তারপর লাশকে বামদিকে কাত করিয়া প্রথমে ডান দিক ধৌত করিবে। তারপর ডানদিকে কাত করিয়া বাম দিক ধুইয়া ফেলিবে। গোসল শেষ করিযা শুস্ক কাপড় দ্বারা সর্ব শরীর ভালরূপে মুছিয়া দিবে।
মাইয়্যেতের গোসল সম্পর্কীয় মাসআলাসমূহ
১) যে ব্যক্তি মাইয়্যেতকে গোসল করাইবে তাহার নিজেরও গোসলের পূর্বে অযু করিয়া লওয়া এবং গোসল করানোর পরে গোসল করা উচিত।
২) মৃত ব্যক্তি পুরুষ হইলে তাহাকে পুরুষ এবং স্ত্রী হইলে তাহাকে স্ত্রী লোকে গোসল করাইবে ।
৩) গোসল করতে পুরুষের জন্য পুরুষ লোক এবং
স্ত্রীলোকের জন্য স্ত্রীলোক না পাওয়া গেলে মাহরুম লোক (জীতিতাবস্তায় যাহার সাথে বিবাহ জায়েয ছিল না) মাইয়্যেতকে তৈয়ম্মুম করাইয়া দিবে, গোসলের প্রয়োজন হইবে না।
৪) মাহরুম লোকের অভাব হইলে অন্য কোন ব্যক্তির হাতে কাপড় পেঁচাইয়া তৈয়ম্মুম করাইয়া দিবে।
৫) লোকাভাবে স্ত্রী স্বামীকে গোসল করাইতে
পারিবে, কিন্তু স্বামী স্ত্রীলোকে গোসল করাইতে
পারবে না।
৬) অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক বালিকাদিগকে স্ত্রী-পুরুষ যে কেহ গোসল করাইতে পারে।
৭) সন্তান ভুমিষ্ট হইয়া মূহুর্তমাত্র জীবিত থাকিয়া মরিয়া গেলে তাহাকেও গোসল করাইতে হইবে, অবশ্য অজু করাইতে হইবে না। আর মাতৃগর্ভ হইতে মৃত ভুমিষ্ট হইলে তাহাকে গোসল করাইতে হইবে না।
৮) কেহ পানিতে ডুবিয়া মরিলে তাহাকেও গোসল করাইতে হইবে। অবশ্য পানি হইতে উঠাইবার সময় গোসলের নিয়তে তিন বার নাড়িয়া চাড়িয়া উঠাইলে গোসল আদায় হইয়া যায়।
৯) ধর্ম যুদ্ধে শহীদ ব্যক্তিকে গোসল করাইতে হয় না।
১০) সমস্ত শরীর একবারে পানি বহাইয়া গোসল করান ওয়াজিব, কিন্তু তিন তিনবার করিয়া সমস্ত শরীরে পানি ঢালিয়া ধৌত করা মুস্তাহাব।
কাফনের কাপড়
মৃত লাশকে যে কাপড় পরিধান করাইয়া সমাধিস্থ করা হয় তাহাকে কাফন বলে। লাশকে কাফন দেওয়া ফরযে কেফায়া। পুরুষ এবং স্ত্রী লাশের কাফন দেওয়ার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রহিয়াছে। যথাঃ পুরুষের জন্য মোট তিনখানা কাপড় ব্যবহার করিতে হয়।
১) লেফাফা বা চাদর
২) পিরহান
৩) ইযার বা তহবন্দ।
ইহা পুরুষের জন্য সুন্নত কাফন।
পুরুষের জন্য কেফায়া কাফন দুইখানা; যথা-
১) চাদর।
২) ইযার। অর্থাৎ এই দুইখানা কাফন পরাইলেই ফরযে কেফায়া আদায় হইয়া যায়। ওজর বশতঃ কাপড় না মিলিলে পুরুষকে শুধু একখানা কাপড় অর্থাৎ ইযার পড়াইয়াও দাফন করা যায়। ইহাকে পুরুষের জরুরত কাফন বলে।
স্ত্রীলোকের জন্য সুন্নত কাফন পাঁচখানা। তাহার প্রথম
তিনখানা পুরুষের মত আর অতিরিক্ত দুইখানা
১) ছিনাবন্দ এবং
২) ওড়না।
স্ত্রীলোকের জন্য কেফায়া কাফন তিনখানা যথাঃ
১) চাদর
২) পিরহান এবং
৩) ইযার।
স্ত্রীলোকের জরুরত কাপড় দুইখানা।
১) চাদর (লেফাফা) এবং
২) ইযার। লেফাফা মাথা হইতে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীর চেয়ে কিছু বেশী লম্বা করিবে। পিরহান ঘাড় হইতে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত লম্বা করিবে। স্ত্রীলোকের ছিনাবন্দ হাঁটু পর্যন্ত চওড়া করিবে এবং ওড়না দুই হাত দৈর্ঘ্য ও এক হাত প্রস্থ্য রাখিবে।
কাফন পড়াইবার নিয়ম
পুরুষের লাশ হইলে একখানা খাট বা তক্তার উপরে প্রথমে চাদর তারপর ক্রমান্বয়ে ইযার ও পিরহান বিছাইবে। তারপর কাফনের উপরে লাশ শোয়াইয়া উহার নাক, ললাট ও ছিনা ইত্যাদি স্থানে কিছু
খুশবু লাগাইয়া প্রথমে পিরহান লেপটাইবে। এইভাবে চাঁদরও লেপটাইয়া দিবে।
স্ত্রীলোকের লাশ হইলে প্রথমে ছিনাবন্দ বিছাইবে তারপর ক্রমান্বয়ে লেফাফা, ইযার ও পিরহান বিছাইবে। তারপর লাশ শয়ন করাইয়া পুরুষের ন্যায় খুশবু লাগাইয়া প্রথমে পিরহান পরাইবে। তারপর মাথার চুল দুই ভাগ করিয়া কাঁধের দুই দিক দিয়া আনিয়া বুকের উপর রাখিবে এবং ওড়না মাথায় জড়াইয়া উহা দ্বারা ছিনার উপরের চুলও ঢাকিয়া দিবে। তারপর প্রথমে বামদিক হইতে এবং পরে ডান দিক হইতে ক্রমান্বয়ে ইযার, লেফাফা ও ছিনাবন্দ পরাইয়া দিবে। কাফন পরান হইয়া গেলে একটু পেঁচাইয়া মাথার উপরে ও পায়ের নীচে নেকড়া কিংবা সূতা দ্বারা হালকাভাবে বাঁধিয়া দিবে।
কাফন পরাইয়া তাহার উপরে কিছু আতর বা অন্য কোন সুঘ্রাণ জাতীয় জিনিস মাখিয়া দিবে।
ধর্মযুদ্ধে শহীদ ব্যক্তিকে যেমন গোসল কারাইবার দরকার হয় না, তেমন তাহাদের কাফন পরানোর প্রয়োজন হয় না, বরং তাহাদের পরিহিত রক্তমাখা কাপড়েই তাহাদিগকে দাফন করিবে। লাশ দাফন করিবার পর যদি কবর হইতে কোন জন্তু উহা বাহির করিয়া ফেলে বা অন্য কোন ভাবে বাহির হইয়া পড়ে এবং দেখা যায় যে, লাশের কাপড় বিনষ্ট বা অপহৃত হইয়াছে, তখন লাশ পঁচিয়া গলিয়া গিয়া না থাকলে আবার নতুন ভাবে কাফন পরাইয়া দিবে। আর যদি ইহা পঁচিয়া গলিয়া যাইয়া থাকে তবে একখানা কাপড় দ্বারা পেঁচাইয়া দিবে। মৃত ব্যক্তির গোসল সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে কিতাবাদি পড়া দরকার।
ইসলামী জ্ঞান আহরনের জন্য আরো পড়ুন